তেহারির ইতিহাস --
সালটা ১৯৩৯,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে।সারা পৃথিবী জুড়ে খাদ্যের আকাল,ভয়াবহ পরিস্থিতি। ভারত উপমহাদেশের আর্থিক অবস্থাও তথৈবচ, কিন্তু খাদ্যের বিষয়ে পৃথিবীর কোন জাত কবেই বা লোভ সংবরণ করতে পেরেছে? চারশো সাড়ে চারশো বছরের পুরোনো যে বিরিয়ানি মুঘল সাম্রাজ্যের হাত ধরে বেড়া টপকে প্রবেশ করেছিল এদেশে সেই বিরিয়ানিই প্রায় তিনশো বছর পর অভাবের তাড়নায় বদলে গেল তিহারি হয়ে, অর্থাৎ বলা যায় পরিবেশ পরিস্থিতির প্রভাবে বিরিয়ানির পরিমার্জিত সংস্করণই তিহারি বা তেহারি,
এখন প্রশ্ন আসে কমতি বা ঘাটতি করতে গিয়ে বিরিয়ানির সাথে তেহারি কিভাবে বদলালো? আসলে বিরিয়ানিতে অনেক বড় বড় মাংসের টুকরো ব্যবহার করা হত যা তেহারিতে বদলে হল ছোট ছোট করে কাটা টুকরো, এমনকি বিরিয়ানির বহুল পরিমাণ মশলার ব্যবহারও কমিয়ে অনেক কম করা হল তিহারিতে
সামান্য কয়েকটি উপকরণ একত্র করে খরচ কমিয়ে নব কলেবরে নতুন রূপে যে সন্তান পৃথিবীর বুকে এলেন তিনি ক্রমশ স্বাদে গন্ধে বর্ণে অতুলনীয়া হয়ে উঠতে থাকলেন। বর্তমানে বাংলাদেশ অথেনটিক ডিশ কথাটির সাথে সগৌরবে উচ্চারিত হয় তেহারি। প্রধানত গরুর মাংস দিয়ে তৈরি হলেও আজকাল মুরগী অথবা পাঁঠার সাথে জমে জ্যাম হয়ে যাচ্ছে এই রান্নাপদটি।
অনেকক্ষণ ধরে আপনাদের সামনে খাদ্যের আগে তার ইতিহাস আর সৃষ্টিযাপন নিয়ে বকেই চলেছি,মুখে পান গলায় গান জিভে শান আর খোঁপায় বেলীফুলের টান না থাকলে এত কথা জমে? নাহ!জমে না। ঠিক বলেছেন। বরং চলুন গল্প করতে করতে রান্নাবাড়াটা করে নিই
উপকরণ ---
প্রধানত তিন ধরণের চাল দিয়ে এই রান্নার প্রচলন আছে,চিনিগুড়া চাল গোবিন্দভোগ চাল এবং কালিজিরা চাল। না পাওয়া গেলে অগত্যা বাসমতী। প্রথমেই চালটা ভাল করে তিন চারবার জল বদলে বদলে ধুয়ে নিতে হবে,যাতে ওপরের স্টার্চটা ধুয়ে যায়।এবার জল ছেঁকে একটা পরিস্কার কাপড়ের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে একদম শুকনো ঝরঝরে করে নিতে হবে।
এরপর স্পেশাল তিহারি মশলা তৈরির পালা। একটা বড় এলাচ চারটে ছোট চারটে লবঙ্গ একটু জায়ফল একটু জয়িত্রী কয়েকটা গোলমরিচ অল্প শাহজিরে এবং তেজপাতা শুকনো কড়াইয়ে নেড়ে নিয়ে মিক্সিতে মিহি গুঁড়ো করলেই তৈরি তেহারি মশলা
পদ্ধতি --
আচ্ছা অনেকক্ষণ গল্প হল,এবার রান্না তৈরির পর্যায়।প্রথমে মাংস রান্না, চিকেনের পিসগুলো ভালো করে ধুয়ে অল্প নুন দই আদা রসুন বাটা দিয়ে ঘন্টা দুয়েক ম্যারিনেট করে রাখতে হবে,গ্যাসে একটা ননস্টিক প্যান বসিয়ে তাতে প্রায় হাফ কাপ সর্ষের তেল (ছ'শ গ্রাম মাংস) দিতে হবে।এই রান্নার প্রথম এবং প্রধান উপকরণ হল সর্ষের তেল। তেল গরম হলে তাতে গোটা কিছু মশলা ফোড়ন দিয়ে কুচিয়ে রাখা পেঁয়াজ। অল্প বাদামি হলেই ম্যারিনেটেড চিকেন।কষিয়ে নিয়ে ঢাকাচাপা।যতক্ষণ না জল শুকিয়ে মাংস সেদ্ধ না হয়
এবার আসল কাজ। ভাত তৈরি। আরেকটা ননস্টিক প্যান। আবার পরিমাণ মত সর্ষের তেল।পুরোনো ঢাকার অলিতে গলিতে আজও এই তেহারি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। সম্পূর্ণ রান্নাটা সর্ষের তেলে হয়, এতে একটা ঝাঁঝালো ফ্লেভার যুক্ত হয়।স্বাদও হয় দারুণ। কথা বলতে বলতে তেল গরম হয়ে গেছে।গোটা কিছু মশলা আবার ফোড়নে দিয়ে সুন্দর গন্ধ আসা অব্ধি ভেজে গন্ধ বেরোতে শুরু করলে স্লাইস করা পেঁয়াজ। একটু রঙ বদলাতে শুরু করলেই অল্প করে আদারসুন বাটা, কাঁচা গন্ধ চলে গেলে ধুয়ে রাখা চাল।এবার গ্যাস কমিয়ে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে চাল ভেজে নেয়ার পালা।যত ফাটা ফাটা সাদা করে চাল ভাজা হবে তেহারি তত ঝরঝরে হবে। চাল ভাজা হয়ে গেলে জলের মাপ।যতটা চাল ঠিক তার ডবল জল সাথে পরিমাণ মত নুন আর চিনি।মানে চাল যদি চার কাপ হয় তাহলে জল আট কাপ।এবার এই আট কাপের মধ্যে আমি ছয় কাপ গরম জল ব্যবহার করেছি বাকি দুই কাপ দুধ। অথেনটিক তেহারিতে ফুল ক্রিম দুধ দিলে স্বাদ হয় লাজবাব । দুধজল সমেত চালে বাবল উঠতে শুরু করলে রান্না করা চিকেন মিশিয়ে ঢাকা দিয়ে পনের থেকে কুড়ি মিনিট নির্দিষ্ট সময় পর ঢাকনা খুললে দেখা যাবে জল শুষে গিয়ে চাল মাংস সেদ্ধ হয়ে একদম ঝরঝরে তেহারি রেডি,ওপর থেকে ছড়িয়ে দিতে হবে চিরে রাখা কাঁচালঙ্কা একটু ঘি, সর্ষের তেলের আর কাঁচালঙ্কার ঝাঁঝ মিলেমিশে হৈচৈ কান্ড
টিপস
১)পোলাও বা বিরিয়ানি বা তেহারি, গরম জল ব্যবহার করুন
২)দুধের সাথে মিল্ক পাউডার মিক্সড করে রান্নায় ব্যবহার করতে পারেন,স্বাদ হবে অসাধারণ
৩)চাল ভাজা যত ভালো হবে তেহারি তত ঝরঝরে হবে
৪)সম্পূর্ণ রান্নাটা শুদ্ধ কাচ্চি ঘানির সর্ষের তেলে করলে স্বাদ ভালো হবে,ঠিক এই কারণেই একে কাচ্চি বিরিয়ানিও বলা হয়
Comentários