মহালয়ার আদিঅন্ত আর সাথে লুপ্তপ্রায় মৎসমূখী শাপলা
"আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর,ধরণীর বহিরাকাশে......"
মহালয়ার ভাের। আকাশবাণী কলকাতা। বিশেষ অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-র কণ্ঠতে স্তোত্র-পাঠ। কাশফুল শিউলি একশোআট পদ্ম... সব মিলিয়ে মিশিয়ে দুর্গাপূজা নাকি মহালয়া। বিস্তর আলাপ এসব নিয়ে। অথচ আমরা যারা অতি সাধারণ মানুষ তাদের চোখে মহালয়ার ভোর বললেই চোখের সামনে কিছু প্রাচীন দৃশ্যকল্প। বাবা বা জ্যেঠু তর্পণ করতে যাচ্ছেন গঙ্গায়। এদিকে বাড়িতে তেল হলুদ মাখিয়ে মৎসবরণ আর সারাদিনের ছুটি। 'বাজল ছুটির ঘন্টা'র মতো একটা আনন্দবিহ্বল উজ্জাপণ।
তবু ইতিহাস পুরাণ কিছুই পিছু ছাড়ে না। প্রচলিত রীতিও আমাদের বুকের ভিতর জাঁকিয়ে বসে থাকে জগদ্দল পাথরের মতো। আজ মহালয়ার ভোরে যখন ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিবেশীর উঠোনের শিউলির গন্ধ আর স্থলপদ্মরঙ,তখন কোন সুদূরে হারিয়ে যেতে যেতে অকারণেই নিয়ে বসলাম পুরোনো কিছু বইপত্তর।
১৯৩০ সাল। বাণীকুমার চণ্ডীমঙ্গলের ওপর রচনা করলেন একটি কাব্য,যেখানে গদ্যের রূপ ছিল,ছিল পদ্যও। নামকরণ করলেন "বসন্তেশ্বরী"।গানের আয়োজন করলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক সাথে স্তোত্রগান পাঠ করলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বাসন্তী পুজোর ষষ্ঠীতে আকাশবাণীতে প্রচারিত হল। ঠিক পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৩১ সালে বসন্তেশ্বরী বদলে হল মহিষাসুরমর্দিনী। সেই বছর বাসন্তী পুজোর পরিবর্তে দুর্গাপুজোর মহাষষ্ঠীর দিন সম্প্রচারিত হল সেই পরিবেশনা। ১৯৩২ সাল থেকে সময় পরিবর্তন করে ষষ্ঠীর কয়েকদিন আগে মহালয়ার দিন সম্প্রচারিত হতে শুরু করল এই বেতার অনুষ্ঠান। তারপর থেকে আজ অবধি আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি, আমাদের ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে গেছে মহালয়ার ভোর
মহালয়া আর দুর্গাপুজো -- ওতোপ্রোতো ভাবেই জড়িত। কেন? কিভাবে? এই উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হবে সেই সময়ে যখন থেকে হিন্দুধর্মে মানা হয় যে, যে কোনো শুভ অনুষ্ঠানের পূর্বে পূর্বপুরুষকে জলদান রীতি। সেই নিয়ম মেনেই এই দুর্গা মহোৎসবের সূচনা পর্বে আসে মহালয়া। মহালয়া আসলেই বোধনের আগের পিতৃতর্পণ। ঠিক যেমন বিবাহ বা উপনয়নের আগে নান্দীমুখ। আসলে কোনো শুভ অনুষ্ঠানের আগে পিতৃপুরুষদের স্মরণ করাই তো মনমানসকে উন্নত করা। চলার পথকে সুগম করা। যে সামাজিকতার সাথে আমরা বড় হয়ে উঠি, যে reach culture আমাদের জন্মসূত্রে প্রাপ্ত তাকে অস্বীকার করার প্রশ্নই ওঠে না যেখানে,সেখানে জলদান তো অবশ্য কর্তব্য। শ্রাদ্ধের নিয়মেও এই কারণেই তিলদান নামক একটা পর্ব আছে। হিন্দু ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত্যুর পরেও আত্মা ছেড়ে যায় না তার আত্মীয়দের। এমনকি হিন্দু ধর্ম বলে আত্মার কোনো মরণ নেই। পুড়ে যায় শুধুই দেহ খোলস। আর এই যুক্তি মেনেই মহালয়ার দিন স্বর্গত পিতৃপক্ষকে তিলজল দান করেই শুভ সূচনা হয় দেবীপক্ষের। শ্রী তপন আচার্য তাঁর ‘মহালয়া’ নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন “কালক্রমে দেবতাদের স্বরূপ অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ায় ‘পিতৃগণ’ নামধারী সূর্যার্ঘ্য দান রূপান্তরিত পিতৃপুরুষের অর্পণে"
এ তো গেল ধর্মকথা। পুরাণ কাহিনী কিন্তু বলছে অন্য গল্প। সেই গল্পে মহাভারত এসেছে। এসেছে সেই সংক্রান্ত কিছু গল্প। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। কর্ণের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা স্বর্গে গমন করলে সেখানে তাঁকে খাদ্য হিসেবে দেওয়া হয় লক্ষকোটি স্বর্ণমুদ্রা আর রকমারি নানান বহুমূল্য রত্ন। সেই রত্নসম্ভার দেখে স্বর্ণ দেখে তিনি আশ্চর্য হয়ে যান।জানতে চাইলে তাঁকে বলা হয় মানুষ হিসেবে জীবিত অবস্থায় তিনি এইসকল জিনিস ছাড়া কাউকে কিছু দান,করেননি কোনো দিন। কর্ণ উত্তরে বলেন তিনি পিতৃপুরুষ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। তাদের কোনোদিন তিনি খাদ্য পানীয় দান করেননি। তখনই ইন্দ্রের নির্দেশ আসে। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ প্রতিপদ তিথিতে কর্ণ ১৬ দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করেন। তারপর আশ্বিনের অমাবস্যা তিথিতে শেষ জল প্রদান করে তিনি স্বর্গে ফিরে যান। তারপর থেকে তাঁর এই ঘোরদশা কেটে যায়।
আর এই দিনটিকে হিন্দুমতে পিতৃপক্ষ বলা হয়। আর এই পিতৃপক্ষের শেষ দিনই হল মহালয়া। মহালয়া কথাটির অর্থ হল মহা আলয়। সংস্কৃত ভাষায় মহালয়াকে একটি তিথি হিসেবে ধরে স্ত্রীলিঙ্গ মানা হয়েছে। মহালয়া হলাে শারদীয়া দুর্গাপুজাের অব্যবহিত পূর্বের অমাবস্যা। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের অমাবস্যা।