
মল্লভূমের মাটি- পর্ব ৩ রাজা বীর হাম্বীর
Updated: Dec 18, 2021
তখন আটচল্লিশতম মল্লরাজ ধাড়ীমল্ল বয়সের ভারে ন্যুব্জ। যুবরাজ হাম্বীর শৌর্য বীর্যে বেশ উজ্জ্বল। আশেপাশের রাজ্যেও লোকের মুখে মুখে ফেরে তাঁর বীরত্বের কথা। রাজা হবার পর তাঁর বিচক্ষণ রাজনৈতিক বুদ্ধি আর অসীম বীরত্বের গল্প আজও বিষ্ণুপুরের অন্দরে কান পাতলে শোনা যায়। তবে সে অনেক পরের কথা। ধীরে ধীরে আমরা আলোচনা করব তাঁর সেইসব অমর কাহিনী। এখন আবার ফিরে আসি সেই যুবরাজ হাম্বীরের কথায়। হঠাৎ মোঘলদের চিরশত্রু উড়িষ্যার পাঠান নবাব সুলেমান কররাণির পুত্র দাউদ খাঁ বিষ্ণুপুর আক্রমণ করে বসেন। যুবরাজ হাম্বীর তাঁর দক্ষ সেনাদল নিয়ে এগিয়ে যান শত্রুদের আটকাতে। প্রথমে দায়ুদ খাঁয়ের নেতৃত্বে লক্ষাধিক সৈন্য দেখে একটু পিছিয়ে যেতে বাধ্য হন বীর যুবরাজ। কিন্তু তারপর নিজেকে গুছিয়ে কৌশলে আছড়ে পড়েন শত্রুদের ওপর এবং দুইপক্ষের প্রচুর প্রাণের বিনিময়ে তিনি পাঠান দায়ুদ খাঁকে পরাস্ত করেন। সেইদিন যুদ্ধের মাঠে জমে যায় মৃতদেহের স্তুপ আর কথিত আছে যুবরাজ হাম্বীর শত্রুদের মুণ্ড থেকে মালা বানিয়ে অর্পণ করেন কূলদেবী মৃন্ময়ী মাকে। শত্রুদমনের সেই জায়গা আজও বিষ্ণুপুরে মুণ্ডমালার ঘাট নামে বহু পরিচিত। এতো গেলো যুবরাজ তরুণ হাম্বীরের কথা। আর রাজা ধাড়ীমল্লের মৃত্যুর পর যখন তিনি সিংহাসনে বসেন তখন তাঁর বীরত্বের কাহিনী যেন শেষই হয় না। তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বুদ্ধি আর দূরদর্শীতায় তিনি মোঘল - পাঠান যুদ্ধে মোঘল পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। সম্রাট আকবরের সাথে সুসম্পর্ক তাঁকে অনেকটা শক্তিশালী করেছিল সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহও নেই। সম্রাট আকবর শাসনের সুবিধের কথা ভেবে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যকে মোট ১৬ টি জায়গীরে ভাগ করেন। তার মধ্যে বাংলার দায়িত্ব পান স্ময়ং রাজপুত সেনাপতি মানসিংহ। একবার সন্ধি করার ফাঁদে ফেলে তৎকালীন পাঠান নবাব কতলু খাঁ মানসিংহের পুত্র জগৎসিংহকে তুলে নিয়ে যান উড়িষ্যায়। স্বাভাবিক ভাবেই বিচলিত হয়ে পড়েন রাজা মানসিংহ। বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বর্তমান আরামবাগের কাছে ছাউনি ফেলেন তিনি। সেই সুযোগে নিজের রাজ্যের মধ্যে মোঘল পাঠান দ্বন্ধে তিনি সেনাসমেত সরাসরি সাহায্য করেন মানসিংহকে এবং প্রায় একক বিক্রমে যুদ্ধ করে ছাড়িয়ে আনেন জগৎসিংহকে এবং বন্দী অবস্থায় হত্যা করে সমাধিস্থ করেন কতলু খাঁকে। সেই স্থানটিই আজ কতলু খাঁয়ের নাম অনুযায়ী বর্তমান বাঁকুড়ায় কোতুলপুর নামে খ্যাত। যুদ্ধের পরে স্বাভাবিক ভাবেই মোঘলদের সুনজরে পড়ে যায় সেযুগের বন-বিষ্ণুপুর (বিষ্ণুপুরের তৎকালীন নাম)। এমনকি সেদিন বাদশার দরবারেও হাম্বীরের হয়ে বহু প্রশংসা করেছিলেন রাজা মানসিংহ। কৃতজ্ঞতাবশত বিষ্ণুপুরের ওপর থেকে করের বোঝা পর্যন্ত তুলে নিয়েছিলেন বাদশা আকবর। প্রায় ৫০০ বছর আগেও মল্লভূমের মত জঙ্গল অঞ্চলে তাঁর দক্ষ শাসনব্যবস্থার সুবিধার জন্য এক একটি দৃঢ় পদক্ষেপ আজকের মানুষকেও অবাক করে। দ্রুত যোগাযোগব্যবস্থার সুবিধার জন্য তিনি সমগ্র মল্লভূম জুড়েই উঁচু উঁচু স্তম্ভ তৈরি করেছিলেন। শত্রু আক্রমণের খবর এতে তাঁর কাছে অনেক আগেই খুব সহজে পৌঁছে যেত। এই স্তম্ভগুলোকে তখন বলা হত 'মাচান'। আজও বাঁকুড়ায় কোনো কোনো জায়গায় এইসব স্তম্ভের ভাঙা অংশ দেখা যায়। বাঁকুড়া স্টেশনের কাছে 'মাচানতলা' অঞ্চলের নামকরণের কারণও এটিই। যদিও নাম থাকলেও এই অঞ্চলের মাচানটি বহুকাল আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে।

এ এক সফল রাজার কাহিনী। এক দোর্দন্ডপ্রতাপ অথচ প্রজাবৎসল শাসকের গল্প। তাঁর গল্প যত বলা যায় ততই কম হয়ে যায়। অথচ এই বীর রাজাকে আজও কতজন বাঙালি ঠিকমতো চিনে উঠতে পেরেছেন! ঘুরতে ঘুরতেও দেখেছি বিষ্ণুপুরের বেশিরভাগ ভ্রমণপ্রিয় বাঙালিই মন্দির দেখেন, বালুচরি কেনেন। কিন্তু বাংলার গর্ব রাজা বীর হাম্বীরের নাম পর্যন্ত জানেননা অনেকেই।
রাজধর্মের উগ্রতা আর কর্তব্যের দায়বদ্ধতা ছেড়ে তখন পরম বৈষ্ণব হয়ে গুরু শ্রীনিবাসের সাথে বৃন্দাবনে থাকছেন বিষ্ণুপুরের মল্ল অধিপতি রাজা বীর হাম্বীর। মাঝেমাঝে যে একদম নিজের রাজ্যে আসেন না তা নয়। তবে বেশিরভাগ সময়ই পড়ে থাকেন কৃষ্ণসাধনা ও নিজের আরাধ্য দেবতাকে নিয়ে। হরিভক্তির জোয়ারে প্রায় একরকম গল্পকথায় পরিণত হয়েছে তার সেই আগের বিক্রম, মুর্শিদাবাদের নবাবের সামনে শিড়দাঁড়া সোজা করে কথা বলার দৃপ্ততা, অথবা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে পাঠান কতুল খাঁয়ের থেকে রাজা মানসিংহের ছেলে জগৎ সিংকে ছাড়িয়ে আনার দিনগুলো। যেন কিছুটা মনে পড়ে যায় সম্রাট অশোকের চণ্ডাশোক থেকে কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে ধর্মাশোকে পরিণত হওয়ার কাহিনী। রাজা বীর হাম্বীরের জীবনও তেমন স্পষ্ট দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশে প্রজাপালক, দিগ্বিজয়ী, শত্রুকে শিহরণ জাগানো এক বীর শাসকের ভূমিকায় আর দ্বিতীয় অংশে পরম ধার্মিক, ঈশ্বরপ্রেমী ও বৈষ্ণব এক পদকর্তার আঙ্গিকে। এই ধারাবাহিকের আগের পর্বে আমরা তাঁর রচিত পদ নিয়েও আলোচনা করেছি। বৃন্দাবনের অধ্যক্ষ শ্রীজীব গোস্বামী তাঁকে শেষ জীবনে 'চৈতন্যদাস' নাম দেন। মল্লাধিপতি, মোঘল সম্রাট আকবরের বিশ্বস্ত বন্ধু রাজা বীর হাম্বীর ক্রমে পরিণত হন সাদামাটা জীবনের অধিকারী এক বৈষ্ণব অনুরাগীতে। দুহাত তুলে সংকীর্তন করে ঘুরে বেড়ান বৃন্দাবনের রাস্তায়। কালের সাথে দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজার এমন প্রেক্ষাপট পরিবর্তন বাংলার ইতিহাসে একেবারেই বিরল বলা যায়। গবেষক ও ঐতিহাসিকরা তাই আজও তাঁর বৈচিত্র্যময় জীবন নিয়ে সমান আগ্রহী। তাঁর জীবনের প্রতিটি মোড়ে এসে যেন থমকে দাঁড়াতে হয় মুহুর্মুহু। কী ভীষণ বহুমাত্রিকতা, কত রঙের সমাহার।
যাই হোক, এবার আসি একটি ঘটনায়। তখন বৃন্দাবন থেকে রাজধানী বন বিষ্ণুপুরে ফিরছেন রাজা হাম্বীর। পথে ক্লান্ত রাজা নিজের পরিচয় লুকিয়ে আশ্রয় নিলেন বীরভূমের বৃষভানুপুর গ্রামের এক মন্দিরের অতিথিশালায়।

মন্দিরের অপরূপ কৃষ্ণমূর্তি দেখে মোহিত হলেন বৈষ্ণব রাজা। পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করে জানলেন মূর্তির নাম মদনমোহন। দেখার পর থেকেই যেন খাওয়াদাওয়া ত্যাগ করলেন তিনি। বিষ্ণুপুর না নিয়ে যেতে পারলে যেন জীবনটাই বৃথা তাঁর। যথারীতি কথাটা পেড়েই ফেললেন পুরোহিতকে। কিন্তু এই প্রস্তাব শুনে তো আকাশ ভেঙে পড়লো পুরোহিতের। ইতিমধ্যে তিনি অতিথির রাজপরিচয়ও জানতে পেরেছেন। তাই নিজের ইষ্টকে হারানোর আশঙ্কায় তাঁর প্রায় উন্মাদদশা। ইতিমধ্যে মদনমোহন মূর্তিতে বিমোহিত রাজা একরাতে মন্দিরের গর্ভগৃহ থেকে মূর্তি চুরি করে সোজা পালালেন বিষ্ণুপুরে নিজের রাজধানীতে। তারপর সকলের দৃষ্টির আড়ালে নিজের ভক্তিতে শুরু করলেন মদনমোহনের নিত্যসেবা। যার খবর জানা রইল কেবল রাজা, তাঁর স্ত্রী, মা এবং রাজপুরোহিতের। এদিকে নিজের ইষ্টমূর্তি হারিয়ে পাগলের মত ঘুরতে ঘুরতে বিষ্ণুপুর এসে পোঁছলেন বৃষভানুপুরের ব্রাহ্মণ পুরোহিত। অচেনা জায়গা, তার ওপর আবার রাজসাক্ষাৎ। রীতিমতো কষ্ট করে বৈষ্ণব রাজার সঙ্গে দেখা করার পর কথাটা পেড়েই ফেললেন তিনি। ইষ্ট ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত এতটুকু শান্তি নেই তাঁর। অথচ প্রথম প্রশ্নের পরেই যথারীতি অস্বীকার করলেন ধার্মিক রাজা বীর হাম্বীর। মদনমোহন নিয়ে বিষ্ণুপুরের ধার্মিক প্রেক্ষাপটে শুরু হল এক নতুন টানাপোড়েনের অধ্যায়।
----
Kaushik Chakroborty