
মল্লভূমের মাটি - ৬ ( সংগীত চর্চা)
বিষ্ণুপুর। শাস্ত্রীয় সংগীতের শহর। সুরের শহর। সময়টা ত্রয়োদশ শতকের শেষ ভাগ। বিষ্ণুপুর রাজসিংহাসনে তখন রাজা পৃথ্বী মল্ল। দেবতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নাচগানের প্রচলন সেখানে তখন থেকেই শুরু হয় বলে জানা যায়। কূলদেবতার সামনে সংগীতচর্চার জন্য তিনি বহু গায়কদের জড়ো করেছিলেন রাজধানী বিষ্ণুপুরে। এরপর এই ধারা বজায় রেখে ৪২ তম রাজা শিব সিংহও দেবতার দরবারে নৃত্যগীতের দিকে মন দেন। শুধু দেবতার কাছেই নয়। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় দেবতার সাথে সাথে প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য গানের ব্যবস্থা করা হয় দরবারে। বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজারা চিরকালই সংগীতপ্রেমী। তাঁদের আনুকুল্যে বহু গায়করাই আজীবন সংগীত সেবা করে গেছেন মল্লভূমের মাটিতেই। বিষ্ণুপুরের সাংগীতিক ইতিহাস বলতে গেলে অবশ্যই উঠে আসে রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহের প্রসঙ্গ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে রাজধানীতে সংগীত চর্চার জন্য তিনি দিল্লী থেকে আনলেন স্ময়ং বাহাদুর খাঁকে। বাহাদুর খাঁ যে সে গায়ক নন। একেবারে সম্রাট আকবরের দরবারে নবরত্নের এক রত্ন তানসেনের বংশধর। তাঁর সাথে আনলেন আরও কয়েকজন প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় সংগীতের পণ্ডিতদের। সেই সময় বাহাদুর খাঁয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করল সেই অঞ্চলের বহু ছাত্র। সুরে সুরে সরগরম হয়ে উঠল বিষ্ণুপুর। আর শুধু দেবতার জন্য নয়, সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল বিষ্ণুপুরের সংগীত সুগন্ধ। তৈরি হয়ে গেল বাংলার একমাত্র নিজস্ব শাস্ত্রীয় সংগীতের ঘরানা। বিষ্ণুপুর সংগীত ঘরানা। প্রায় তিনশ বছর ধরে চলতে থাকা এই ঘরানায় ভারতবর্ষ পেয়ে গেল বহু সংগীতাচার্যকে।

বিষ্ণুপুরের সংগীত তারকাদের মধ্যে যাঁর নাম প্রথম উঠে আসে তিনি হলেন যদুভট্ট। অর্থাৎ যদুনাথ ভট্টাচার্য্য। ১৮৭৫ সালের আষাঢ়ে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ হল - "ব্রহ্মসংগীতের উন্নতির জন্য শুরু হচ্ছে সংগীত শিক্ষার স্কুল। ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরের দ্বিতলায় প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে এই স্কুল। সংগীত শেখাবেন বিষ্ণুপুর ঘরানার বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী যদুনাথ ভট্টাচার্য্য"।
এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছেলেবেলায় সংগীত গুরু যদুভট্টের কাছে গান শিখেছিলেন বহুদিন। তাঁরই সতীর্থ অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায় বিষ্ণুপুর সংগীত জগতের আর এক কিংবদন্তি। বিষ্ণুপুর শাস্ত্রীয় সংগীত ঘরানাকে আরও ছড়িয়ে দিতে তিনি তাঁর তিন পুত্র ও বাছাই করা কয়েকজন শিষ্যদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। তাঁরই এক পুত্র গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় বিষ্ণুপুর ঘরানার একজন দিকপাল। তিনি বহুদিন বর্ধমানরাজের সভাকবির আসল অলঙ্কৃত করে রেখেছিলেন। তাঁর লেখা গ্রন্থ সঙ্গীতার্ণব ও সঙ্গীতচন্দ্রিকা আজও বাংলার শাস্ত্রীয় সংগীতের সম্পদ। ১৯৬২ সালে তাঁকে কলকাতায় সংগীত নাটক ফেলোশিপ সম্মানে ভূষিত করা হয়। তাঁর ছোটভাই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম গায়ক ও সংগীতশিল্পী। এরপর আজ পর্যন্ত সে সকল জ্যোতিষ্কের হাত ধরে বিষ্ণুপুরের সংগীত ঘরানা পৌঁছে গেছে ভারতের সমস্ত কোণে কোণে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী গৌরীদেবী, তাঁর কন্যা সুলেখাদেবী, আশালতা দেবী। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা বিন্ধ্যবাসিনী দেবী, সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধচন্দ্র নন্দী প্রমুখ। এঁদের হাত ধরেই বিংশ শতাব্দীতে বিষ্ণুপুর হয়ে উঠেছিল শাস্ত্রীয় সংগীতের 'ছোট দিল্লী'।
বিষ্ণুপুরের শাস্ত্রীয় সংগীতের ঐতিহ্য লিখতে বসলে যেন শেষই হয় না৷ ১৩৭০ খ্রীস্টাব্দে মল্লরাজদরবারে যে সংগীত ঘরানার সূত্রপাত ঘটেছিল, আজও বাংলার ঐতিহ্য ধরে রেখে সারা দেশে সে এক ব্যতিক্রমী সংগীত পরম্পরা। এরপর সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কট্টর ইসলামপন্থায় সময়ে বহু সঙ্গীতজ্ঞ বাংলায় চলে আসেন। তাঁরা খবর নিয়েছিলেন বাংলায় মল্ল রাজারা গানবাজনার পৃষ্ঠপোষক। এভাবে লোকমুখে শুনে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর থেকেই বিষ্ণুপুরে আগমন ঘটতে থাকে অসংখ্য সঙ্গীতজ্ঞের। সংস্কৃতিপ্রেমী মল্লরাজরাও আদরের সাথে তাঁদের ঠাঁই দেন রাজদরবারে। এভাবেই রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ দেব উস্তাদ বাহাদুর খাঁকে সভাগায়ক নিযুক্ত করেছিলেন। এমনকি সেই সময় রাজানুকম্পায় তিনি দরীদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের থেকে একটি কড়ি পর্যন্ত নিতেন না। এভাবেই মল্লভূমের মাটিতে ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে ভবিষ্যতের এক স্বতন্ত্র সংগীত ঐতিহ্য। বাহাদুর খাঁয়ের শিষ্য পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য্যকেই বিষ্ণুপুর ঘরানার প