গল্পঃ মনের কোণে ( সাধন চন্দ্র সৎপথী)
আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণে জমাট বাঁধা মেঘটা একটু একটু করে ঘর-বাড়ি, গাছের মাথা ছাড়িয়ে অনেকটা উপরে উঠে এসেছে।

পরেশ দ্রুত হাতে বেসন গুলছে।দোকানে বাঁশের বেঞ্চে দু-চারজন খদ্দের বসে আছে --গরম গরম চপ আর চা খাবে।
বকুল চা করছে। বকুল ভালো চা করতে পারে। খদ্দেররা বলে-"আমাদের এখানে বৌদির মতো ভালো চা করতে আর কেউ পারে না।"
শুনে বকুল হাসে।
তেলটা গরম হয়েছে কিনা দেখার জন্য পরেশ বেসনের একটা ছোট্ট ডেলা তেলে ফেলে দিল।
আরও দু'চারজন খদ্দের এসে দোকানে ঢুকল। যারা 'শুধু চা খাবো' বলল বকুল তাদের চা দিল।
এবার তেল বেশ গরম হয়ে উঠেছে। পরেশ একসঙ্গে কয়েকটা চপ ছেড়ে দিল। একটা হাতা দিয়ে উল্টে -পাল্টে ভাজতে লাগল।
বকুল গ্যাস লাইটটা ভিতরের ঘর থেকে বের করে এনে একটা টুলের উপর রাখল।
দোকানের মধ্যে আলাদা একটা ঘর আছে --ওটা স্টোর রুম। বাকি অংশটায় টিনের চালা করা আছে। তিন দিক ঘেরা চালাটার সামনেটা খোলা। বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে ঝাপটা তোলা আছে --নামিয়ে দিলে ওটাই কপাট হয়ে যায়। এখানের লোক এই ধরনের কপাটকে বলে 'ঝাঁপ-কপাট'।
কড়াই থেকে চপগুলো তুলে পরেশ একটা ট্রেতে রাখল। আবার কতকগুলো কড়াইয়ে ছেড়ে দিল। খদ্দেরদের আর যেন ধৈর্য্য ধরছে না।তারা ব্যস্ত হয়ে উঠল -"বৌদি ,এদিকে চারটা দিবে। ও বৌদি ,এখানে দুটা দিবে। "
বকুল শালপাতায় মুড়ে চপ দিতে লাগল, সঙ্গে চা।
বাইরের দিকে তাকিয়ে পরেশ দেখল- প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে ,মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝিলিক হানছে।বাতাসের জোর বাড়ছে।
খদ্দেরদের মধ্যে জোর আলোচনা চলছে- 'খবরে নাকি বলেছে -জোর ঝড়- বৃষ্টি হবে।'
চপ ভাজতে ভাজতে পরেশ অবাক হল -খবর জেনেও এরা কেমন নিশ্চিন্তে বসে চা-চপ খাচ্ছে ! যেন বাড়িঘর নেই অথবা থাকলেও যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই !
পরেশের মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠল।
আসলে খদ্দেরের এই ভিড় একেবারই ভালো লাগছে না আজ।
কিন্তু বকুলের বিরক্তি নেই -চপ দিয়ে যাচ্ছে -আর মাঝে মাঝে কারো কোনো মজার কথা শুনে খিলখিল করে হাসছে।
বকুলের এই হাসি ভালো লাগে না পরেশের। খদ্দেরের সঙ্গে এত হাসি মশকরা করার কি আছে রে ,বাপু! কোনোদিন লোকে এই নিয়ে গুজুর- ফুসুর করবে।
এমনিতেই তো বাজারে অনেক চা- দোকানদার বলে -"পরেশদার দোকানে এত ভিড় চা- চপের জন্য নয় ; বকুলের হাসির জন্য। অমন মিষ্টি হাসি দেখলে তেতো চা-ও মিষ্টি লাগবে !"
কথাগুলো পরেশের সামনে কেউ বলে না ; কিন্তু ঘুরে ফিরে কানে আসে।
বকুলকে একদিন বলেছিল -"লোকে পাঁচ কথা বলছে। খদ্দেরের সঙ্গে এত হাসি- মশকরা না করাই ভালো।"
শুনে বকুল রেগে গিয়েছিল। চোখ দু'টো ঘুরিয়ে বলেছিল -"আমি কোথায় হাসি মশকরা করি ? খদ্দেররাই মজার মজার কথা বলে-আমি তো আর পাথর নই ,যে হাসির কথা শুনেও হাসব না ।"
পরেশ ঢোঁক গিলে বলেছিল -"না ,মানে হাসতে বারণ করিনি -তবে পাঁচ জনে পাঁচ কথা বলে কিনা।"
--"তাহলে আমাকে তো ঘরে রাখলেই পারো , দোকানে আসতে বল কেন? আমি প্যাঁচার মতো মুখ করে বসে থাকতে পারব না। তুমি তো কাছেই থাক -কোনো বেচাল দেখতে পাও ?এমন মেয়ে আমি নই।তবু লোকের কথা যদি এতই গায়ে লাগে কাল থেকে দোকানে আর আসব না। "
পরেশ চুপ করে যায়। বুঝতে পারে- বকুল না এলে একা দোকান সামাল দেওয়া সহজ হবে না। কম বয়সী একটা ছেলে রেখে হয়তো চালানো যায় ; কিন্তু আজকালকার ছেলে কাজ করতেই চায় না --শুধু ফাঁকি মারার তাল খোঁজে।"
তাছাড়া আরও একটা অসুবিধা আছে পরেশের-হিসাবটা ঠিক মতো করতে পারে না।একসঙ্গে পাঁচজন চা- চপ- মুড়ি খেলে কত হল-- বলতে পারে না।
অভাবের সংসারে লেখাপড়া শেখার সুযোগ হয়নি। ছোটোবেলা থেকেই বাবুর বাড়িতে কাজ করে ,বাপের সঙ্গে বাবুর জমি চাষ করে দিন কেটেছে। লেখাপড়া শিখবে কেমন করে ?
একটু বডো় হওয়ার পর সন্ধ্যার সময় সতীশ কাকার চা- দোকানে যেত। সতীশ কাকাই চা- চপের হাতে খড়ি দিয়েছিল।
অন্যদিকে ক্লাস এইট পাশ করে নাইন পর্যন্ত পড়েছে বকুল। অবশ্য তারপর আর পড়তে পায়নি। বাবা অক্ষম হয়ে পড়ায় দাদারা আর স্কুলে পাঠাতে চায়নি।
পরেশের বাবা দেখে-শুনে 'শিক্ষিত' বকুলকে বউমা করে ঘরে এনেছে।সেই 'শিক্ষিত' বউয়ের দাপটে পরেশ চুপ করে থাকে। বুঝতে পারে- লেখাপড়া জানে না বলেই বকুল তাঁকে মানতে চায় না।
তবু পরেশ বোঝাবার চেষ্টা করে।
আসলে খদ্দেরদের সঙ্গে বকুলের বেশি কথা বলা ,হাসি -ঠাট্টা করা পরেশ নিজেই সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে গোপাল এলে বকুল যেন খুব খুশি হয়ে ওঠে। খুব মজা করে গোপালের সঙ্গে। কথায় কথায় হাসে। আর অন্যদের চেয়ে গোপালকে একটু যেন বেশি খাতির করে।
দেখে -শুনে পরেশের খুব রাগ হয় কিন্তু কিছু বলতেও পারে না।বললেই বকুল প্রথমে রাগ করে , তারপর কান্না-কাটি করে।
হঠাৎ টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা গেল --সঙ্গে সঙ্গে তা থেমেও গেল।
পরেশ দেখল -অন্ধকার আরও ঘন হয়েছে , বাতাসের জোর আগের চেয়ে বেড়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে -জোর ঝড়-বৃষ্টি হবে।
আরও কয়েকজন খদ্দের দোকানে ঢুকল। বেশিরভাগই পরিচিত ; দু একটি নতুন মুখও আছে।
বকুল আপ্যায়ন করে খদ্দেরদের বসতে বলছে ; হাসিমুখে জানতে চাইছে -"কার কি লাগবে?"
টিনের চালে ক্রমাগত বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে এবার। বাতাসের জোর আরও বেড়েছে।
পরেশ অবাক হল-ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে ; অথচ এখনও লোডশেডিং হল না !
দোকানের দেওয়াল ঘড়িটায় সবেমাত্র সাতটা বেজেছে।
বাতাসে উড়ছে জলকণা- উড়ে এসে ঢুকছে দোকানে।
পরেশ উঠল- ঝাঁপ-কপাটটা নামিয়ে দিল।বাঁশের খুঁটিগুলো একটু বাঁকা করতেই দোকানের দরজাটা আধাআধি বন্ধ হয়ে গেল।জলের ছাঁট আর আসছে না ভিতরে। বাতাসও ঢুকছে না বেশি।
দু'একজন খদ্দেরের কথার উত্তরে "হুঁ - হ্যাঁ "করতে করতে পরেশ আবার উনুনের সামনে বসল। চপ ভেজে ট্রে-তে তুলতে লাগল।
একজন জিজ্ঞাসা করল-"তোমার মা- বাবা কেমন আছেন ?গ্রামেই আছেন ,নাকি বড় ছেলের কাছে?"
উত্তরে পরেশ কিছু বলতে যাচ্ছে , কিন্তু আর বলা হল না-কারণ ঠিক তখনই অর্ধেক বন্ধ ঝাপ-কপাটের তলা দিয়ে গলে গোপাল এসে দোকানে ঢুকল।
গোপালকে দেখেই রাগে পরেশের মাথা জ্বলে গেল -আজও আসার কামাই নেই !
কিন্তু বকুল গ্রাহ্য করে না পরেশের রাগ।
উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল -"এসো গোপাল , আজ এই ঝড় -বাদলে না বের হলেই পারতে। ইস্, একেবারে ভিজে গেছ যে ! শুকনো গামছা আছে- দেবো? মাথা মুছে নাও ,তোমার আবার ঠান্ডা লাগার ধাত ?"
বকুলের কথা শুনে পরেশ বডো় বড়ো চোখ করে তাকাল। খদ্দেরদের কেউ কেউ ঠোঁট টিপে হেসে মুখ লুকালো।
গোপাল একজনকে সরিয়ে বেঞ্চে বসে পড়ল। তারপর বলল -"ঝড়-বৃষ্টিতে আসব না বলেই ভেবেছিলাম ; কিন্তু তোমার চায়ের টানে ছুটে আসতেই হল। দাও, চা দাও।"
বকুল চোখ নাচিয়ে , ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল।
ফুটন্ত তেলে ভাসমান লাল লাল চপগুলোকে হাতা দিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল পরেশ।
বকুল হাসতে হাসতে বলল -"শুধু চা , নাকি গোটা দুই চপও দেবো ,গোপাল ? বৃষ্টি- বাদলে শুধু চা ভালো লাগবে কেন ?"
গোপাল হাসতে হাসতে বলল -"চপ খেতে আমার ভাল লাগে না ,বেগুনি হলে খেতে পারি। "
গোপালের সঙ্গে আর দু'চার জন যোগ দিল -"হোক বেগুনি -দু-চার পিস করে খাওয়া যাবে।"
পরেশ বিরক্ত হয়ে বলল -"না এখন আর বেগুনি হবে না।"
-"আহা সবাই যখন চাইছে তখন কটা ভেজেই দাও না।আমি নাহয় বেগুন ফালি করে দিচ্ছি।"-বলেই বকুল বঁটি আর বেগুন নিয়ে বসে পড়ল।
পরেশ চুপ করে রইল। দমকা বাতাস এসে উনুনের আগুনের জোরটা হঠাৎ বাড়িয়ে দিল।
পরেশের মনে হল- দু একটা ছেলে -মেয়ে থাকলে বকুল এতক্ষণ দোকানে থাকতে পারত না। ছেলে-মেয়ের টানে দোকানে আসাও কমে যেত।
কিন্তু চার বছর হল বিয়ে হয়েছে-একটাও ছেলে- মেয়ে হল না ! একদিন দোকান বন্ধ রেখেই শহরে গিয়েছিল ডাক্তারবাবুর কাছে। সব কিছু পরীক্ষা করে ডাক্তারবাবু বলেছিলেন -"মন খারাপ করবেন না ,ছেলে -মেয়ে হবে ; তবে কিছুদিন ওষুধ খেতে হবে বকুলকে।"
এক বছর হয়ে গেল ডাক্তারবাবুর ব্যবস্থা মতো ওষুধ খেয়ে চলেছে বকুল , কিন্তু....
হঠাৎ আলোর ঝলকানি দেখা গেল ঝাপ -কপাটের ফাঁকে।একটু পরেই কান ফাটানো আওয়াজ।জোর বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
আর সঙ্গে সঙ্গেই লোডশেডিং হয়ে গেল।
বকুলের চুড়ির রিনিঝিনি আর খিল খিল হাসির শব্দ শোনা গেল।
চার্জারটা জ্বলে উঠল।
ঠিক তখনই দোকানের সামনেটা আবার আলোকিত হয়ে উঠল। কিন্তু এবার আর বাজের আলো নয় -মোটর বাইকের আলো ! বাইকটা থেমেছে দোকানের সামনে।সবার কৌতূহলী চোখ তাকিয়ে আছে বাইরের আলোটার দিকে। হয়তো রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে থামতে বাধ্য হয়েছে কেউ।
পরেশও তাকিয়ে আছে।
সবাইকে চমকে দিয়ে দোকানে ঢুকলেন এক মহিলা।পরনে দামি শাড়ি- প্রায় পুরোটাই ভিজে গেছে।কানে ,গলায় সোনার গয়না। সিঁথিতে সিঁদুর ,হাতের সোনার শাঁখা বাঁধা।চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। এলোমেলো চুল থেকে জল ঝরে পড়ছে।
এরকম সুন্দরী মহিলাকে দোকানে ঢুকতে দেখে সবাই অবাক হয়ে গেছে।
গোপালও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে-এমন খদ্দের পরেশদার দোকানে আসেনি আগে !
কিন্তু মহিলাকে দেখে পরেশের মনে হচ্ছে-"কোথায় যেন দেখেছি, অথচ মনে করতে পারছি না ! "
মহিলাটি বেঞ্চে বসা লোকগুলির দিকে তাকালেন- সবাই একটু নড়েচড়ে বসল।
মহিলাটি দরজার দিকে মুখ করে মিষ্টি সুরে ডাক দিলেন -"কই গো , ভিতরে এসো -বাইরে দাঁড়িয়ে রইলে কেন ?"
বাইকের আলোটা নিভে গেল।
দোকানের ভিতরে এসে ঢুকলেন একজন সুবেশ পুরুষ। পরনে দামি প্যান্ট -শার্ট, চোখে চশমা। এক হাতে হেলমেট ,অন্য হাতে একটি ব্যাগ। চেহারায় আর পোশাকে আভিজাত্যের ছাপ লেগে আছে।
বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে পরেশ বলল -"আসুন স্যার ,এখানে বসুন। একটু সরে যাও তো তোমরা -ওই বেঞ্চটা ছেড়ে দাও। "
খদ্দেররা অন্য বেঞ্চে বসল ঠেসাঠেসি করে।
পরেশ বলল-"বসুন স্যার ,দিদিমণি বসুন।একেবারে ভিজে গেছেন --শুকনো কিছু সঙ্গে থাকলে ....।"
বকুলকে বলল -"ভালো করে চা করে দাও।স্যার ,বেগুনি খাবেন ? গরম আছে-এইমাত্র ভেজেছি। "
ভদ্রলোক সম্মতি জানালেন। আড়চোখে তাকিয়ে দোকানের লোকজনকে একবার দেখে নিলেন। খদ্দেরদের মধ্যে একটা অস্বস্তির ভাব দেখা গেল-আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল।
বকুলও আড়ষ্ট হয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে।
পরেশ বেগুনিগুলো ট্রে-তে রাখল। কাজের মাঝে তাকাতেই দেখতে পেল-মহিলাটি তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন -চোখে কৌতুক, মুখে হাসি ।সঙ্গের ভদ্রলোককে কী যেন বললেন মৃদু স্বরে ! উনিও হেসে পরেশের দিকে তাকালেন।
পরেশ মনে মনে লজ্জা পেয়ে গেল। শাল পাতায় মুড়ে বেগুনি নিয়ে কাছে আসতেই - মহিলাটি জিজ্ঞাসা করলেন-"তুমি পরেশদা না ?আমাকে চিনতে পারছ না ? আমি রুমি।"
পরেশ হেসে বলল-" আপনি রুমি দিদিমণি ! চেনা চেনা মনে হচ্ছিল , কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না। কতদিন পরে দেখলাম -তাই ঠিক চিনতে পারিনি !"
রুমি হেসে বলল -"সে নাহয় পারোনি কিন্তু আমি তোমার কাছে 'আপনি' হলাম কী করে? যেমন 'তুমি 'বলতে তেমনই 'তুমি 'বল।"
পরেশ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। শালপাতায় মোড়া বেগুনি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল -"তুমি কোনোদিন আমার দোকানে আসবে -স্বপ্নেও ভাবিনি ! আজ আমার ভাগ্য খুব ভালো দেখছি। "
রুমি বলল-" বাবা- মাকে দেখতে যাব বলে বেরিয়েছি। কাগজে পড়েছিলাম- ঝড়- বৃষ্টি হতে পারে। ভেবেছিলাম আগেই পৌঁছে যাব। কিন্তু রাস্তায় দেরি হয়ে গেল-বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। "
পরেশ বলল -"ভাগ্যিস বৃষ্টি এল , তাই তোমার সঙ্গে দেখা হল। তোমার কিন্তু চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। "
রুমি হেসে বলল -"পরিবর্তন তোমারও হয়েছে। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দোকানে ঢুকে তোমাকে দেখে চেনা চেনা মনে হল -তারপর তোমার বাম হাতের কাটা দাগটা দেখে বুঝতে পারলাম -তুমি পরেশদা।"
-" কাটা দাগটার কথা তোমার এখনও মনে আছে !"-পরেশ চা করতে করতে বলল।
বকুল সেই যে খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ,আর নড়েনি -পা দুটোকে কে যেন মাটিতে গেঁথে দিয়েছে।
বাচাল গোপালের মুখে কোনো কথা নেই ; বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে।
পরেশের কথা শুনে রুমি হেসে বলল-" মনে থাকবে না ? তোমাকে কম জ্বালাতাম নাকি ! "
সঙ্গের ভদ্রলোকটির দিকে তাকিয়ে বলল- "জানো ,এই পরেশদা আমাদের বাড়িতে থাকতো ছোটোবেলা থেকেই। আমার চেয়ে মাত্র পাঁচ বছরের বড়ো।আমাকে 'রুমি দিদিমণি' বলে ডাকতো। আমার জন্য খেজুর ,পেয়ারা পেড়ে আনতো। গাছের ডালে দোলনা বেঁধে দিত।দোলনা বাঁধতে গিয়েই একদিন পড়ে যায়। নিচু ডাল থেকে পড়েছিল, তাই অন্য কিছু হয়নি --তবে হাতটা ভেঙে গিয়েছিল। বাবা সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর আমার সে কী কান্না ! "
রুমির সঙ্গী ভদ্রলোক কিছু না বলে হাসলেন।
পরেশ চা এনে দুজনের হাতে ধরিয়ে দিল। রুমির দিকে তাকিয়ে ইশারা করে জানতে চাইল- 'ভদ্রলোকটি কে ? '
-"ইনি হলেন আমার বাবার জামাই।" -"মানে , তোমার বর। "
রুমি হাসতে হাসতে বলল- "হ্যাঁ। পুলিশে চাকরি করে। বড়ো অফিসার।চোর ,ডাকাত ,গুন্ডা, বদমাইশরা প্রতাপের প্রতাপে কাঁপে।"
খদ্দেরদের মধ্যে কে যেন হঠাৎ কেশে উঠল। আড়চোখে তাকিয়ে পরেশ দেখল -গোপাল কাশছে !
পরেশ হেসে বলল -"আমার আর ভয় কি --আমি তো চোর ডাকাত নই ! তাছাড়া উনি আমার জামাইবাবু।"
চায়ে চুমুক দিয়ে প্রতাপ বললেন -" অর্থাৎ আপনার সঙ্গে আমার মিষ্টি একটা সম্পর্ক আছে।আপনি রুমির 'পরেশদা' তাই আমারও 'পরেশদা'।"
পরেশ বিনীতভাবে বলল-" আমাকে 'আপনি' বলবেন না, জামাইবাবু। আমি অতি সাধারণ মানুষ -লেখাপড়াও জানি না।"
রুমি বলল -"বাবা তো তোমাকে লেখাপড়া শেখাতে চেয়েছিলেন ; স্কুলে ভর্তি করে দেবার কথা বলেছিলেন। তখন তুমি বলেছিলে- 'জ্যেঠামশাই, লেখাপড়া শিখে আমি বাবু হতে চাই না ,গরিব চাষির ছেলে বাবু হয়ে গেলে যে চাষ করতে পারব না। তা এখন কি তুমি চাষ করছ,পরেশদা ?"
পরেশ জানতে চাইল -" জ্যেঠামশাই, জেঠিমা ভালো আছেন তো ? কতদিন দেখিনি।"
-"একবার তুমি গিয়ে দেখে আসবে। বাবা এখনও তোমার কথা বলেন।"
তারপর প্রতাপের দিকে তাকিয়ে বলল -"জানো ,এই পরেশদার খুব ইচ্ছা ছিল -আমি দিদিমণি হই। তাই 'রুমি দিদিমণি' বলে ডাকতো। পরেশদা, আজ আমি দিদিমণি হয়েছি -একটা গার্লস স্কুলে পড়াই।"
পরেশের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল ,বলল -"আমি জানতাম তুমি দিদিমণি হবেই। পড়াশুনায় কী মন ছিল তোমার ! পড়ার সময় এতটুকু বিরক্ত করলেও আর রক্ষে ছিল না।"
রুমি চোখ দুটো কপালে তুলে কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করে বলল -"ওমা, কী মিথ্যা কথা বল তুমি ,পরেশদা ! পড়াশুনায় আমার মন ছিল ? বাবা-মা তো সবসময় বলতেন -'এমন ফাঁকিবাজ মেয়ে আর দেখিনি।'"
পরেশ বলল -"সে উনারা আদর করে বলতেন। পড়ায় ফাঁকি দিলে দিদিমণি হলে কি করে?"
প্রতাপ হেসে বললেন-"একেবারে ঠিক কথা ,পরেশদা। পড়ে পড়ে চোখ দুটোকেই নষ্ট করে ফেলেছে- তাই নাকের উপর চশমা ঝোলাতে হয়েছে।"
পরেশ হো হো করে হেসে উঠল।
খদ্দেররা এক এক করে দোকান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।গোপালও কেটে পড়েছে কখন ! বৃষ্টি এখন আর তেমন জোরে পড়ছে না।
বকুল অবাক চোখে পরেশের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো ভাবছে-মানুষটার মধ্যে এত হাসি ,এত আনন্দ এতদিন কোথায় লুকিয়েছিল ? সে তো কোনোদিন খোঁজ পায়নি। এ যেন অন্য পরেশ ! তাঁর জানা- চেনা সেই বিষন্ন ,রাগী পরেশ নয়।
রুমি বলল-" পরেশদা ,দেখ তো বৃষ্টি থেমেছে কিনা ?"
পরেশ হাসতে হাসতে বলল -"এত তাড়া কেন ? আজ এই গরিবের বাড়িতে থেকে যাও- কাল সকালে দুজনে যাবে।"
-"এখানে বাড়ি করেছে নাকি পরেশদা ?"-রুমির কণ্ঠে বিস্ময়।
-" বাড়ি বলা যাবে কিনা সন্দেহ আছে। মাথা গোঁজার আস্তানা বলতে পার। চলনা, এই তো কাছেই।তোমাদের থাকার অসুবিধা হতে দেবো না।"
রুমি হেসে বলল -"নিমন্ত্রণটা জমা রইল। প্রতাপের ছুটি নেই- কাল সকালেই ফিরে যেতে হবে।আবার যেদিন আসব ,দেখে আসব।"
পরেশ হাসতে হাসতে বলল -"কথা দিলে কিন্তু-মনে থাকে যেন।"
রুমি বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল-" কথা দিলে আমি কথা রাখতে চেষ্টা করি ,পরেশদা। স্কুলে চাকরিটা পাওয়ার পর তোমাকে খবরটা দেবার জন্য মনটা কেমন করত ; কিন্তু তুমি সেই যে চলে গেলে আর খোঁজ পাইনি। এই দোকানটা যে তোমারই-জানতে পারিনি।এবার থেকে যাওয়া -আসার পথে ঠিক দেখা করে যাব ।"
পরেশ দোকানের বাইরে বেরিয়ে এল। বৃষ্টি একেবারেই থেমে গেছে -আকাশ পরিষ্কার। রাস্তায় চলাচল শুরু হয়েছে।
ঝাঁপ কপাটটা পুরোপুরি তুলে দিল। এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস দোকানে ঢুকল।
রুমি দোকানের বাইরে বেরিয়ে এল।
প্রতাপ বাইকে স্টার্ট দিলেন।
পরেশের দিকে তাকিয়ে রুমি বলল- "আজ আসি পরেশদা ,আবার দেখা হবে।"
পরেশ একটা ঠোঙা রুমির হাতে ধরিয়ে দিল বলল- "শালপাতায় মুড়ে বেগুনি দিয়েছি গোটা কয়েক -বাড়িতে খাবে। তুমি তো বেগুনি মুড়ি খেতে পছন্দ করো।"
রুমি হেসে উঠল। আর তখনই ইলেকট্রিক চলে এল।বাইরের আলোটা জ্বলে উঠল। সেই আলোয় রুমির হাসিটা আশ্চর্য সুন্দর আর রহস্যময় মনে হল পরেশের।
-"পরেশদা আসছি "-বলে প্রতাপ বাইক চালাতে শুরু করলেন।
রাস্তায় উঠতেই বাইকের গতি বাড়ল। রুমি হাত নাড়ল।
বাইকটা চোখের আড়াল হতেই পরেশ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। দেখল-দোকানের দরজার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে বকুল; ঠিক যেন একখানা ছবি।
পরেশ বলল-" চল, দোকান বন্ধ করে এবার বাড়ি যাওয়া যাক।"
কোনো কথা না বলে বকুল গোছগাছ শুরু করল।ক্যাশ বাক্স থেকে টাকা বের করল। গুণে থোক করে পরেশের দিকে বাড়িয়ে ধরল। পরেশ অবাক হল -'অন্য দিন তো বকুলই টাকা রাখে ,আজ আবার আমাকে দিচ্ছে কেন ?'
কিন্তু কোনো প্রশ্ন না করে পরেশ হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল।
দোকানে ভিতরের লাইটগুলি নিভিয়ে দুজনেই বাইরে বেরিয়ে এল।
ঝাপ কপাটটা নামিয়ে দুটো তালা লাগিয়ে দিল। অভ্যাস মতো বার কয়েক টেনে দেখে নিল- তালা দুটো ঠিকমতো লেগেছে কিনা। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
মেঘ কেটে গিয়ে পরিষ্কার আকাশে চাঁদ উঠেছ। চাঁদের আলোয় চারদিক হাসছে - ঠিক যেন রুমির হাসির মতো।
পাশাপাশি হাঁটলেও পরেশ কোনো কথা বলছে না - বকুলও কিছু বলছে না।
হঠাৎ একেবারে কাছেই কয়েকটা কুকুর একসঙ্গে চিৎকার করে ডেকে উঠল।বকুল ভয় পেয়ে পরেশের একটা হাত চেপে ধরল।
পরেশ হেসে উঠল।
মাথার উপর দিয়ে ডানা ঝটপট করতে করতে উড়ে চলে গেল একটা রাতচরা পাখি।
............. ...................
সাধন চন্দ্র সৎপথী
সিমলাপাল ( পারিজাত পল্লী)
বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ