
গল্পঃ মনের কোণে ( সাধন চন্দ্র সৎপথী)
আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণে জমাট বাঁধা মেঘটা একটু একটু করে ঘর-বাড়ি, গাছের মাথা ছাড়িয়ে অনেকটা উপরে উঠে এসেছে।

পরেশ দ্রুত হাতে বেসন গুলছে।দোকানে বাঁশের বেঞ্চে দু-চারজন খদ্দের বসে আছে --গরম গরম চপ আর চা খাবে।
বকুল চা করছে। বকুল ভালো চা করতে পারে। খদ্দেররা বলে-"আমাদের এখানে বৌদির মতো ভালো চা করতে আর কেউ পারে না।"
শুনে বকুল হাসে।
তেলটা গরম হয়েছে কিনা দেখার জন্য পরেশ বেসনের একটা ছোট্ট ডেলা তেলে ফেলে দিল।
আরও দু'চারজন খদ্দের এসে দোকানে ঢুকল। যারা 'শুধু চা খাবো' বলল বকুল তাদের চা দিল।
এবার তেল বেশ গরম হয়ে উঠেছে। পরেশ একসঙ্গে কয়েকটা চপ ছেড়ে দিল। একটা হাতা দিয়ে উল্টে -পাল্টে ভাজতে লাগল।
বকুল গ্যাস লাইটটা ভিতরের ঘর থেকে বের করে এনে একটা টুলের উপর রাখল।
দোকানের মধ্যে আলাদা একটা ঘর আছে --ওটা স্টোর রুম। বাকি অংশটায় টিনের চালা করা আছে। তিন দিক ঘেরা চালাটার সামনেটা খোলা। বাঁশের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে ঝাপটা তোলা আছে --নামিয়ে দিলে ওটাই কপাট হয়ে যায়। এখানের লোক এই ধরনের কপাটকে বলে 'ঝাঁপ-কপাট'।
কড়াই থেকে চপগুলো তুলে পরেশ একটা ট্রেতে রাখল। আবার কতকগুলো কড়াইয়ে ছেড়ে দিল। খদ্দেরদের আর যেন ধৈর্য্য ধরছে না।তারা ব্যস্ত হয়ে উঠল -"বৌদি ,এদিকে চারটা দিবে। ও বৌদি ,এখানে দুটা দিবে। "
বকুল শালপাতায় মুড়ে চপ দিতে লাগল, সঙ্গে চা।
বাইরের দিকে তাকিয়ে পরেশ দেখল- প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে ,মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ ঝিলিক হানছে।বাতাসের জোর বাড়ছে।
খদ্দেরদের মধ্যে জোর আলোচনা চলছে- 'খবরে নাকি বলেছে -জোর ঝড়- বৃষ্টি হবে।'
চপ ভাজতে ভাজতে পরেশ অবাক হল -খবর জেনেও এরা কেমন নিশ্চিন্তে বসে চা-চপ খাচ্ছে ! যেন বাড়িঘর নেই অথবা থাকলেও যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই !
পরেশের মনে মনে বিরক্ত হয়ে উঠল।
আসলে খদ্দেরের এই ভিড় একেবারই ভালো লাগছে না আজ।
কিন্তু বকুলের বিরক্তি নেই -চপ দিয়ে যাচ্ছে -আর মাঝে মাঝে কারো কোনো মজার কথা শুনে খিলখিল করে হাসছে।
বকুলের এই হাসি ভালো লাগে না পরেশের। খদ্দেরের সঙ্গে এত হাসি মশকরা করার কি আছে রে ,বাপু! কোনোদিন লোকে এই নিয়ে গুজুর- ফুসুর করবে।
এমনিতেই তো বাজারে অনেক চা- দোকানদার বলে -"পরেশদার দোকানে এত ভিড় চা- চপের জন্য নয় ; বকুলের হাসির জন্য। অমন মিষ্টি হাসি দেখলে তেতো চা-ও মিষ্টি লাগবে !"
কথাগুলো পরেশের সামনে কেউ বলে না ; কিন্তু ঘুরে ফিরে কানে আসে।
বকুলকে একদিন বলেছিল -"লোকে পাঁচ কথা বলছে। খদ্দেরের সঙ্গে এত হাসি- মশকরা না করাই ভালো।"