গল্পঃ শতাব্দীর পারে (রাজশ্রী মুখার্জি)
অবশেষে সন্দীপ এসে পড়লেন হাজারিবাগের জঙ্গলে ।
নব্বই বছর বয়সেও তাঁকে প্রায় যুবক বলা চলে।বিশাল, দীর্ঘ দেহ,লম্বাটে মুখের কপালে আধপাকা চুল এসে পড়েছে ।ঠান্ডা জলের বোতল থেকে জল গলায় ঢেলে খেলেন।এখনও গ্রীষ্মকাল পড়তে পনেরো কুড়ি দিন দেরি ।তাই অতটা উত্তাপ নেই তবে আবহাওয়া একদম শুষ্ক হওয়ায় গলা শুকোচ্ছে ।আজ একুশশো কুড়ি সালের পঁচিশ মার্চ।আজ থেকে একশো বছর আগে সারা পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসের তান্ডব চলেছিল।সারা পৃথিবীতে এক মিলিয়নেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল ।এরপর মানবসভ্যতার রূপ সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছিল ।মানুষ পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য সবরকম পদক্ষেপ নিয়েছিল।যেসব জায়গায় জঙ্গল ছিল সেগুলোকে আর নষ্ট হতে দেয়নি।সারা পৃথিবী ও তার মানুষদের এতো যত্ন করে রেখেছিল যে মানুষ খুব কমই রোগভোগ করেছে।এছাড়া সবাইকে সুস্থ রাখার জন্য অত্যাধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। যেমন সন্দীপ নিজেই নব্বই বছর বয়সে একদম সতেজ আছেন।তবে কিছুদিন ধরে আবার বহু মানুষের শরীর অকারণেই ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে।তেমন কেউ মারা না গেলেও কারুর অস্থি ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে, কারুর যকৃৎ খারাপ হয়ে যাচ্ছে, কারুর হৃদয়ের গতি কমে যাচ্ছে ।তাদের শুধু আধুনিক চিকিৎসা দিয়ে জীবন চালাতে হচ্ছে ।স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারছে না ।পৃথিবীর কোন ডাক্তার এর কারণ নির্ধারণ করতে পারছেন না ।তাই চতুর্দিকে এক নতুন আতঙ্ক এসে উপস্থিত ।
সন্দীপের অবশ্য তেমন কোন সমস্যা দেখা দেয়নি।তিনি রিটায়ার করার পর, প্রচুর প্রাণশক্তি নিয়ে এক অনাথাশ্রমের দেখাশোনা করেন।তাঁর সন্তানরা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত আর স্ত্রী কয়েক বছর আগে মারা গেছেন । এমনিতে এখন ভারতবর্ষে অনাথের সংখ্যা খুব কম ।তাও যতো আছে তারা চার পাঁচটা অনাথাশ্রমের মধ্যে খুব সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে আছে।এর মধ্যেই একটা সন্দীপ দেখাশোনা করেন।বাচ্চারা তাঁকে সোনাদাদু বলে।এদের মধ্যেও চার পাঁচটা শিশুর এমন লক্ষণ দেখা দিলে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন।তাঁর জন্ম হিন্দু পরিবারে হলেও তিনি প্রতিদিন ধ্যান করার সময় ভগবান বুদ্ধকে স্মরণ করেন।বৌদ্ধধর্ম নিয়ে একটু আধটু পড়াশোনাও করেন।বুদ্ধদেবের ছোট ছোট নীতি গল্পগুলো বাচ্চাদের শোনান।সব থেকে উতলা হয়ে পড়লেন সেদিন ,যেদিন অভয় বলে একটি পাঁচ বছরের শিশুর হঠাৎ পায়ের মালাইচাকির জোড়টা খুলে গেল।তার পা প্লাস্টার করে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে কিন্তু জুড়বে কিনা ডাক্তাররা বুঝতে পারছেন না ।রাতে শোওয়ার আগে সন্দীপ গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন ।হঠাৎ যেন তাঁর অন্তরের মাঝ থেকে কেউ বলে উঠলো ,"হাজারিবাগের জঙ্গলে, এক টিলার ওপর ভগবান তথাগত এসে রয়েছেন ।সেখানে গিয়ে দেখা করো।তিনি পথ দেখাবেন।"হাজারিবাগের জঙ্গল অনেক বড়ো আর সেখানে অনেক ছোট ছোট টিলা আছে।সেখানে তিনি খুঁজে বের করবেন কিভাবে সেকথা তাঁর মাথায় এলো কিন্তু কেমন যেন এক অজানা তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল ।যেভাবেই হোক তাঁকে যেতে হবে । দিন পাঁচেক ধরে আশ্রমের অন্যান্য কর্মীদের সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে তিনি বর্ধমান থেকে চলে গেলেন হাজারিবাগে ।কারুকে কিছু বললেন না, জিজ্ঞেসও করলেন না ।কারণ কোনো লাভ নেই ।এটা তাঁর সম্পূর্ণ নিজস্ব অনুসন্ধান ।আশ্রমের সবাই ভাবলো তিনি অনেকদূর ধরে বিরামহীন ভাবে কাজ করতে করতে ক্লান্ত ।তাই যাচ্ছেন কিছুদিনের জন্য অবসর কাটাতে ।এমনিতে বুদ্ধদেবের তীর্থস্থান গয়া কিন্তু সেখানে লোকালয় হয়ে যাওয়ার কারণেই হয়তো তিনি অরণ্যের গভীরে, একান্তে দেখা দিতে চান ।করোনা হওয়ার পর সব জঙ্গলগুলো শুধু অবিকৃতই রাখা হয়নি ,সেগুলো আরো ঘন হয়ে উঠেছে ।সন্দীপ ,স্টেশন চত্বরের এক হোটেলে উঠে ,রোজ জঙ্গলে পায়ে হেঁটে অভিযান চালাতে লাগলেন।একে তো জঙ্গলে এখন গাড়ি করে যেতে বিশেষ অনুমতি লাগে তাছাড়া সন্দীপ এসব কিছু একাই করতে চান তাই গাড়ি চড়ার কোন প্রশ্নই আসে না ।তিনি ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেছেন ।জঙ্গল, গাছপালা-এসবের বিশেষ জ্ঞান নেই।খালি বুঝলেন চারিদিকে পলাশ ফুল ফুটে আছে।এছাড়া অজস্র প্রজাপতি, ফড়িংএর ওড়াউড়ি, নানারকম পাখির ডাক তাঁকে প্রতিদিন মন্ত্রমুগ্ধ করে দিচ্ছিল।যখন বিকেলে হোটেলে রোজ ফিরে আসেন,সবাই তাঁর দিকে একটু অবাক হয়ে দেখে।তবে তাঁর আত্মস্থ রূপ দেখে কেউ কোনো কথাই বলে না। তাঁর মধ্যে যথেষ্ট শক্তি থাকলেও বয়সের কারণে শরীরে একটু কাঠিন্য এসে গেছে ।তাই প্রথম কয়েকদিন এবড়ো খেবড়ো, অসমতলভূমিতে ঘুরে বেড়ালেন।শুধু অরণ্যের গভীরতা, তার নিজস্ব এক গাম্ভীর্য, বৈচিত্র্যের দেখা মিললো ।ইতিমধ্যে হাজারিবাগ স্টেশনে ,একদিন এক অল্পবয়সী তরুণী ,হঠাৎ পাল্স কমে গিয়ে ,অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।আরো বেশ কিছু মানুষ ফুসফুস দূর্বল হয়ে শ্বাসকষ্টের শিকার হলো।মানুষ এতদিন খুব স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে থেকেছে।পৃথিবীর মানুষের গড় আয়ু এখন অনেক বেড়ে গেছে ।এর মধ্যে এইসব অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো সবার মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করলো।সন্দীপ আরো মরীয়া হয়ে অরণ্যের গভীরে খুঁজতে লাগলেন ভগবান তথাগতকে। বৈশাখী পূর্ণিমার কয়েকদিন আগে থেকে জঙ্গলে পরিবর্তন দেখা গেল।যেন প্রজাপতি, কাঠবেড়ালি, পাখী ও অন্যান্য জন্তু জানোয়াররা একটু বেশিই ব্যস্ত ।জঙ্গলে ঘোরাঘুরির মাঝে কখনও কখনও বসে পড়েন ।জঙ্গলের সোঁদা গন্ধর সঙ্গে, সৌন্দর্যকে উপভোগ করেন ।আশ্চর্য, কত সরীসৃপেরা তাঁর সামনে দিয়ে চলে গেলেও কোনো ক্ষতি করে না।তিনিও তাদের ভয় পান না।দুদিন ধরে এইরকম বসে থাকার সময় তিনি এক মিষ্টি সঙ্গীতের ধ্বনি শুনতে পান।এই কারণে কদিন ধরে এখানেই ঘোরাঘুরি করছেন ।ধীরে ধীরে, অনুভব করতে করতে বুঝতে পারলেন যে ধ্বনিটা একটা টিলার ওপর থেকেই আসছে।অবশেষে বৈশাখী পূর্ণিমা এলো।সেদিনও সন্দীপ ঐ একই জায়গায় এসে বসলেন।এখন প্রায় বিকেল ।সারাদিন ধরে বন যেন হাসছে।রোদের তেজ থাকা সত্ত্বেও তা যেন গায়ে লাগছে না ।আজ আর সন্দীপের এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না ।ক্রমশ সূর্য ঢলে গিয়ে চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে লাগল ।রাতের অরণ্য খুবই ভয়াবহ হয়।কিন্তু সন্দীপের মন এক আবেশে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।তিনি দিনের শেষে নরম আলোয় টিলার ওপর চড়তে লাগলেন ।মনে হল ওদিক থেকে জ্যোতির আভাস আসছে।টিলাটা বেশ খাড়া ।তবে চারিদিকে গাছের ঝুরি ও মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে থাকা শেকড় ধরে তিনি ওপরে চড়তে লাগলেন ।একদম ওপরে পৌঁছতে দেখলেন ,পাহাড়ের গায়ে এক বড় গর্ত ।যাকে গুহা বলা চলে না,সেখানে ভগবান তথাগত বসে আছেন ।তাঁর শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে অপূর্ব জ্যোতি।সেখানে কেমন এক মিষ্টি সঙ্গীতের অস্ফুট ধ্বনি যার উৎস বোঝা যাচ্ছে না ।সন্দীপের সারা শরীরে শিহরণ খেলে গেল ।চোখ দিয়ে নেমে এল আনন্দাশ্রু।কোথায় গেল তাঁর এত ঘোরাঘুরির শ্রান্তি বেদনা। তিনি হাত জোড় করে বলে উঠলেন, "প্রভু মানবজাতিকে রক্ষা করুন ।" তথাগত মুখ খুললেন, "বৎস!আমি মানবজাতিকে রক্ষা করার কেউ নই।মানুষ নিজেরাই নিজেদের উদ্ধার করতে পারে।"তাঁর গলার স্বরটা যেন অনেক দূর থেকে আসছিল। সন্দীপ বললেন, "কিন্তু প্রভু ,আমি তো অনেক আশা নিয়ে এসেছি।" -"সব হবে বৎস।তবে তা মানুষেরই প্রচেষ্টাতে হবে।মানুষকেই নিজের আত্মশক্তিকে জাগাতে হবে।তারা এখন খুব বেশি জাগতিক বস্তুর ওপর নির্ভরশীল ।সেই কারণে নিজেদের ভেতরের শক্তিকে হারিয়ে ফেলেছে।একটা ব্যাপার সবাইকে মেনে নিতে হবে যে রোগ, শোক ,জ্বরা -মানুষের জীবনের অমোঘ সত্যি ।এদের আমরা এড়াতে পারব না।এগুলোকে ভয় পেলেও চলবে না ।মানুষ সেটা না বুঝে শুধু ওষধি সেবন ও অন্যান্য জাগতিক বস্তুর মাধ্যমেই খালি নিজেদের সুস্থ রাখার চেষ্টা করছে।এতে তাদের শরীরের ভেতরে অবস্থিত আত্মশক্তি দূর্বল হয়ে পড়েছে।" -"এর জন্য আমাদের কি করতে হবে?" -"রোজ ধ্যানের মাধ্যমে সবাইকে অনুভব করতে হবে যে এই বিশাল মহাজগতের তারা এক একটা অংশ।তাই তাদের সেই বিপুল শক্তির কণা রয়েছে।তারা সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছে ।আবার সেখানেই মিশে যাবে।তাই অতিরিক্ত ভয় মন থেকে দূর করতে হবে ।প্রতিক্ষণে মানুষ যদি এই সত্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে তাহলে তাদের আত্মশক্তি জেগে উঠবেআর তারা আবার সবল হয়ে উঠবে ।তুমি গিয়ে মানুষের চেতনা জাগ্রত করো। সন্দীপের মনে হলো তাঁর শরীরে যেন এক তরঙ্গ খেলে গেল।তিনি তথাগতকে প্রণাম করে বেরিয়ে এলেন।চারদিকে ঘন অন্ধকার হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পথ দেখতে একটুও অসুবিধে হলো না।তাঁর ভেতর থেকেই এক অনির্বচনীয় জ্যোতি বেরিয়ে আসছে।এই আলো তাঁকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।সারা পৃথিবীর আকাশে আবার যে অন্ধকারাচ্ছন্নতা দেখা দিয়েছে তা দূর করতে হবে ।ভগবান তথাগত যে কয়েক হাজার বছর আগে যে আলো প্রদীপ্ত করে দিয়ে গিয়েছিলেন তা পৃথিবীতে আবার নতুন করে জেগে উঠল সন্দীপের মধ্য দিয়ে ।
সমাপ্ত।
Author:
Rajasri Mukherjee
Sonari West Layout
Jamshedpur